খুলনা | শুক্রবার | ০৩ মে ২০২৪ | ২০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা পরিস্থিতিতে আবেগ নয় সময়ের দাবি মতে চলুন

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:২১ এ.এম | ০৭ অগাস্ট ২০২১

প্রবৃত্তির তাড়না পূরণ নয় আল­াহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের নাম দ্বীন। একবার রসূল সল­াল­াহু আলইহি ওয়াসল­াম আদেশ দিলেন, যখন বৃষ্টি হয় এবং ময়লা কাঁদা এত বেশি হয় যে, চলতে ফিরতে মানুষের খুব বেশি কষ্ট হয়, পা পিছলে যাওয়া আশঙ্কা হয়, ময়লা-কাঁদায় পোশাক নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়, এমতবস্থায় শরীয়ত অনুমতি দিয়েছে যে, মানুষ মসজিদের স্থলে ঘরে নামায পড়বে।(বুখারী)
হযরহ আবদুল­াহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল­াহু আনহুমার ঘটনা। হযরত আবদুল­াহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল­াহু আনহুমা একদিন মসজিদে বসে ছিলেন। ইত্যবসরে আযানের সময় হল। সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিও শুরু হল। মুয়াজ্জিন আযান দিলেন। তিনি মুয়াজ্জিনকে বললেন, এ ঘোষণাও করে দাও, ‘সবাই নিজ নিজ ঘরে নামায পড়–ন।’
কিন্তু এই বাক্য অন্যান্যাদের কাছে খুব অপরিচিত মনে হল। কারণ সর্বদা মানুষ দেখে ও শুনে আসছে যে, মসজিদ থেকে এ ঘোষণা হয়, ‘নামাযের জন্য আস, সফলতার জন্য আস।’ কিন্তু আজ বিপরীত ঘোষণা হচ্ছে, যে নিজ নিজ ঘরে নামায পড়–ন। তাই লোকেরা হযরত আবদুল­াহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল­াহু আনহুমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হযরত! এটা আপনি কি করলেন? আপনি মানুষকে মসজিদে আসতে বারণ করছেন? উত্তরে তিনি বলনে, ‘হ্যাঁ! আমি তা এমন ঘোষণা করাবই। কারণ এমন ঘোষণা সেই সত্ত¡া থেকেও দেয়া হয়েছে, যিনি আমার থেকেও উত্তম এবং তোমার থেকেও উত্তম।’(বুখারী)
সায়েখুল ইসলাম আল­ামা মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, সময়ের দাবি মতে চলার নাম হল দ্বীন। যে সময় দ্বীনের চাহিদা যা হবে, তাই পালন করতে হবে। সময়ের দাবি যদি হয় মাতা-পিতার খেদমত করা, তাহলে যে সময়ে জিহাদের কোন মূল্য নেই, জামাতে নামায পড়ার কোন অর্থ নেই। এসব ইবাদত যথাস্থানে অত্যন্ত ফযীলাতপূর্ণ। কিন্তু দেখতে হবে, এখন আমাকে সর্বপ্রথম কোন কাজটি করতে হবে।
হিজরত ও জিহাদ আল­াহ তা’য়ালার কাছে প্রিয়তম দু’টি আমাল। কিন্তু যদি কারও মাতা-পিতা অসুস্থ কিংবা বৃদ্ধ হয়ে যায় এবং ঐ সময় তাদের সেবা-শুশ্রƒষা করার মত কেউ না থাকে, যখন তাদের জন্য প্রয়োজন খেদমত তবে তাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তখন মাতা-পিতার সেবা করাই তার প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এবং এর ফলে হিজরত ও জিহাদকারীদের সমতুল্য সওয়াব সে প্রাপ্ত হবে।
এক ব্যক্তি রসূলাল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের কাছে আগমন করল এবং বলল, আমি আপনার কাছে হিজরত ও আল­াহর রাস্তায় জিহাদের বায়আত হতে এসেছি। রসূলে কারীম সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম জানতে চাইলেন, তার মাতা-পিতা বেঁচে আছে কিনা? লোকটি উত্তর করল, হ্যাঁ, উভয়েই বেঁচে আছেন। রসূলে কারীম সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম তাকে বললেন, তোমার মাতা-পিতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের সেবা কর।(বূখারী, মুসলিম) এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, যদি ফরজে আইন না হয় তবে মাতা-পিতার অনুমতি ব্যাতিত জিহাদ কিংবা দ্বীন শিক্ষা করার জন্য নিজ শহরের বাইরে যাওয়া যাবে না।
হযরত উয়াইস করনী রহমাতুল­াহি আলাইহির ঘটনা ইতিহাসে দীপ্তিময় হয়ে আছে। রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামকে এক নজর দেখার জন্য যিনি ছিলেন মাতোয়ারা। তিনি রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের হুকুমের সামনে নিজের কামনাকে কুরবান করে দিলেন। মায়ের খেদমতের জন্য তিনি সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য ছেড়ে দিলেন। ফলে তিনি সাহাবী উপাধিতে ভূষিত হতে পারলেন না। অথচ একজন সাধারণ সাহাবার মার্যাদাও এতবেশি যে, একজন ওলী যত বড় ওলীই হোন না কেন, তিনি একজন সাধারণ সাহাবার মর্যাদার কাছেও যেতে পারেন না।
ডাঃ আবদুল হাই রহমাতুল­াহ আলাইহি একটি কথা বলতেন। হৃদয়পটে যতœ করে রাখার মত। তিনি বলতেন, ভাই! নিজের কামনা পূর্ণ করার নাম দ্বীন নয়, বরং দ্বীন হল আল­াহ ও তাঁর রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের আনুগত্য করার নাম। প্রথমে লক্ষ্য রাখবে, আল­াহ ও তাঁর রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম কী চান? সেটা পূর্ণ করা। এটাই দ্বীন। নিজ আগ্রহ আবেগ, কামনা-বাসনা পূর্ণ করার নাম দ্বীন নয়। যেমন কারো আগ্রহ সৃষ্টি হল প্রথম কাতারে নামায পড়ার প্রতি। কারো মনে জাগল, জিহাদ করবে। কারো মনে চাইল দাওয়াত-তাবলীগে সময় দেবে। এসব তো অবশ্যই সওয়াবের কাজ। নিঃসন্দেহে এগুলো দ্বীনের কাজ। তবে তোমাকে দেখতে হবে, এ মুহূর্তে দ্বীনের চাহিদা কী? যেমন তোমার মনে চাইল, জামাতের প্রথম কাতারে শরীক হওয়ার। অথচ ঘরে তোমার মাতা-পিতা খুবই অসুস্থ। নড়া-চড়া করতে পর্যন্ত পারছেন না। তাহলে এ মুহূর্তে জামাতে শরীক হওয়ার চেয়েও মাতা-পিতার খেদমত করার গুরুত্ব অধিক। এ মুহূর্তে আল­াহ তোমার কাছ থেকে এটাই চান। তাই এ মুহূর্তে তোমার কর্তব্য হবে ঘরে একাকী নামায সেরে নেয়া এবং মাতা-পিতার খেদমতে পরিরপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করা। এ মুহূর্তে যদি মাতা-পিতার খেদমত না করে তুমি চলে যাও মসজিদে জামাতে শরীক হতে, তাহলে এটার নাম দ্বীন নয় বরং এটা হবে নিজের কামনাকে অগ্রাধিকার দেয়া।
অবশ্য শরীয়তের এ বিধান তখন প্রযোজ্য হবে, যখন মসজিদ হবে দূরবর্তী অবস্থানে। যদি মসজিদ নিকটেই হয়, সেখানে গেলে মা-বাবার খেদমতে অসুবিধা হবে না, তখন মসজিদে যাওয়াই শ্রেয়।
সায়েখুল ইসলাম আরো বলেন, আপনি মনোযোগ সহকারে বসে আল­াহর যিকির করছেন। এমন সময় আযানের শব্দ কানে ঢুকল। আপনার প্রতি আদেশ এসে পড়ল, যিকির বাদ দাও এবং চুপচাপ আযান শোন এবং তার উত্তর দাও। যদিও তাতে সময় ব্যয় হবে। আযানের সময়টিতে যিকির অব্যাহত রাখলে আরও কয়েকবার আল­াহু নাম উচ্চারিত হত। কিন্তু আপনি থেমে গেলেন। যখন থামিয়ে দেয়া হল, তখন থেমে যান। এখন যিকিরে কোন সওয়াব নেই। এখন সওয়াব আযান শ্রবণ ও তার উত্তর দেয়ার মধ্যে।
ইফতারে দ্রুততা করার আদেশ করা হয়েছে। এই মুহূর্ত পর্যন্ত অনাহার থাকা এবং কিছু না খাওয়া সওয়াবের কারণ ছিল। এই মুহূর্ত পর্যন্ত পিপাসার্ত থাকা সওয়াবের কারণ ছিল। এর অনেক ফযীলাত ও বিপুল সওয়াবের কারণ ছিল। কিন্তু যখন আমি বললাম, খাও, এবার খাওয়ায় বিলম্ব করা গোনাহ। কারণ এখন খেতে বিলম্ব করা অর্থ হল, রোযার মধ্যে তুমি নিজের থেকে যোগ করে নিয়েছ।
সাহরীতে বিলম্ব করা উত্তম। কেউ যদি আগে ভাগেই সাহরী খেয়ে শুয়ে পড়ে, তাহলে এটা সুন্নাতের খেলাফ। বরং সাহরী শেষ মুহূর্তে খাওয়া উত্তম। কেননা আগে ভাগে খেয়ে শুয়ে পড়া মানে রোযার মেয়াদে নিজের থেকে যোগ করা। এটা আনুগত্য নয়- এটা নিজের থেকে কিছু করা।
এজন্য খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে, নিজের চাহিদা ও নিজের প্রবৃত্তির তাড়না পূরণের নাম দ্বীন নয়। দ্বীন হল আল­াহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের নাম। তা আমার বুঝে আসুক বা না আসুক।(ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)
এখন মনে করুন আমি করোনা ভাইরাস বহন করছি এমতাবস্থায় আমি ভিড়ের মধ্য দিয়ে চলাচল করছি, আমার পাশে যে ভাইটি ছিল সে আমার নিকট হতে করোনা ভাইরাস বহন করে তার বাড়িতে নিয়ে গেলো, তার কাছ থেকে তার পরিবারের লোকজন গ্রহণ করল। আবার উল্টাটাও হতে পারে, যেমন আমি কোন ভিড়ের ভিতরে গেলাম সেখানে আমার কোন ভাই এই ভাইরাসটি বহন করছিল, তার কাছ থেকে আমি পেয়ে গেলাম, এবার আমি বাসায় আসলাম এবং আমার নিকট হতে আমার বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তান-স্ত্রী সহ সকলকে দিয়ে দিলাম। এখন সকলের অসুস্থ হওয়া শুরু হল এবং কষ্টের মধ্যে পড়ে গেল তাহলে এটা কি হঠকারিতা নয়। লক্ষ্য করুন, আমার মনের চাহিদা ও প্রবৃত্তির তাড়না পূরণ করতে গিয়ে কতগুলো মানুষকে ক্ষতির সম্মুখীন করলাম। মনে রাখবেন ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা যেখানে গোড়ামীর কোন স্থান নেই। মহান আল­াহ তা’য়ালা কোন ব্যক্তির উপর এমন কোন কাজের বোঝা চাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যের বাইরে।(সূরা বাকারা:২৮৬)
এজন্য আবেগের উপর নির্ভর না করা। সীমানা রক্ষা করে চলা। সময়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে, সময়ের দাবি মতে, যে সময়ে দ্বীনের চাহিদা যা হবে এবং এর জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি এবং উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার প্রয়োজন তাই করা।
তবে মনে রাখতে হবে, সময়ের দাবি মতে চলা এই কথাটি খুব নাজুক। যে কোন বিষয়কে সামনে রেখে দ্বীলের খায়েশাত অনুযায়ী চলার নাম সময়ের দাবি মতে চলা নয়। এখানে আল­াহর হুকুম ও রসূলে কারীম সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের সুন্নাতকে সামনে রাখা। আর এজন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ, দক্ষ, প্রজ্ঞাবান ও দুনিয়াত্যাগী ওলামায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করা এবং তাদের সিদ্ধান্তের উপর আমল করা।
আল­াহই সর্বজ্ঞ। মহান আল­াহ তা’য়ালা আমাদের সঠিকটা বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা।

প্রিন্ট

আরও খবর